কাপাসিয়ায় কৃষি প্রণোদনায় দুর্নীতি, বঞ্চিত কৃষক
আলোকিত প্রতিবেদক : গাজীপুরের কাপাসিয়ায় কৃষি প্রণোদনা প্রদানে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
ফলে করোনাকালে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সরকারের সহায়তা কর্মসূচিতে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না।
কৃষি বিভাগ জানায়, কৃষি মন্ত্রণালয় চলতি বছর পারিবারিক সবজি পুষ্টি বাগান স্থাপনের লক্ষ্যে নগদ টাকা ও ১৪ জাতের বীজ বিনামূল্যে প্রদান করে। সার, বেড়া ও পরিচর্যা বাবদ কৃষকপ্রতি দেওয়া হয় এক হাজার ৯৩৫ টাকা।
কাপাসিয়ার ১১টি ইউনিয়ন থেকে ৩৫২ জনকে উপকারভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। নগদ বরাদ্দ আসে ছয় লাখ ৮১ হাজার ১২০ টাকা।
আলোকিত নিউজ ডটকম বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধান করেছে। তাতে ওঠে এসেছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র।
উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের গাওরার গ্রামে একটি সবজি বাগানের প্রদর্শনী চোখে পড়ে। কৃষাণীর নাম মোতালিবের স্ত্রী হাফসা। ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার মিলি।
তালিকা ঘেঁটে এই উপকারভোগীর নাম পাওয়া যায়নি। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাও সদুত্তর দিতে পারেননি।
স্থানীয়রা জানান, টিম লিডার রোকেয়া বেগমের জমিতে লোক দেখানো সবজি বাগান তৈরি করা হয়েছে। হাফসা নামের কোন নারীকে তারা চেনেন না।
এক পর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিলি ভুয়া প্রদর্শনীর কথা স্বীকার করে নিউজ না করার অনুরোধ করেন। তার পক্ষে একাধিক ব্যক্তিও তদবির করেন।
গাওরার মমতাজ বেগম জানান, তিনি টাকা পাননি। শুধু বীজ পেয়েছেন। তার ও ছফুরা বেগমের মোবাইল নম্বরের স্থলে ওই মিলির নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
নয়ানগর গ্রামের জামালের মোবাইল নম্বরের স্থলে জনৈক নাজমুলের নম্বর ও কুশদী গ্রামের কামাল হোসেনের মোবাইল নম্বরের স্থলে জনৈক এমারত হোসেনের নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। তারা কিছুই পাননি বলে জানান।
লোহাদী গ্রামের সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি টাকা পাননি। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এস এম ইকবাল হোসেনও অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন।
টোক ইউনিয়নের উলুসারা গ্রামের ইউনুছ আলীর ছেলে ইব্রাহীম জানান, তার বাবা তার বিকাশ নম্বরে ১৯৩৫ টাকার স্থলে ১৭০০ টাকা পেয়েছেন।
কাশেরা গ্রামের হাবিবুর রহমানের মোবাইল নম্বর হিসেবে জনৈক মাজহারুলের স্ত্রী খাদিজা পারভীনের নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি কিছুই পাননি।
নয়াসাঙ্গুন গ্রামের বোরহান উদ্দিনের মোবাইলে একাধিকবার কল করলে সিলেটের মৌলভীবাজারের আবদুল খালেক নামের একজন রিসিভ করে কিছু জানেন না বলে জানান।
শহর টোক গ্রামের মোশারফ হোসেন জানান, তিনি টাকা, বীজ, সাইনবোর্ড-কিছুই পাননি।
সুলতানপুর গ্রামের নুরুল হক জানান, তিনি ৩৫ টাকা কম অর্থাৎ ১৯০০ টাকা পেয়েছেন। তার কাছ থেকে খরচের কথা বলে ৪০০ টাকা নেওয়া হয়েছে।
ডুমদিয়া গ্রামের আলী আকবর ও চেওরাইট গ্রামের জাকির হোসেন জানান, তারা ১৩৫ টাকা কম অর্থাৎ ১৮০০ টাকা করে পেয়েছেন।
সিংহশ্রী ইউনিয়নের পূর্ব ভিটিপাড়া গ্রামের নুরুল হক ও ডোয়াইনগর গ্রামের জাকির ২৩৫ টাকা কম অর্থাৎ ১৭০০ টাকা করে পেয়েছেন।
১ নং ওয়ার্ডের মেম্বার (বড়বের) নুরুজ্জামান মুকুলও তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি বীজ পেয়েছি। কিন্তু টাকা পাইনি।
কড়িহাতা ইউনিয়নের আনজাব গ্রামের রঞ্জনের মোবাইল নম্বরের স্থলে উদয়নের নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি টাকা পাননি বলে জানান।
একই গ্রামের রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী নিয়াজুল ইসলাম, শিক্ষক আতিকুল ইসলাম ও তরুল গ্রামের শিক্ষক নূরুল ইসলামকে তালিকাভুক্ত করায় সাধারণ কৃষকরা বঞ্চিত হয়েছেন।
চরখামের গ্রামের কুদ্দুস মোল্লা জানান, তিনি ১৩৫ টাকা কম অর্থাৎ ১৮০০ টাকা পেয়েছেন।
সনমানিয়া ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামের বিল্লাল ও ধানদিয়া গ্রামের পূর্ণ চন্দ্র জানান, তারা ১৩৫ টাকা কম অর্থাৎ ১৮০০ টাকা করে পেয়েছেন।
চরনিলকিয়া গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান ইউপি মেম্বার। তালিকায় নাম লিখিয়ে তিনিও কৃষি সহায়তা নিয়েছেন।
চাঁদপুর ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মাস্টারের ছেলে রাসেল সরকার চাঁদপুর বাজারের বড় ব্যবসায়ী। প্রণোদনার তালিকায় তার নাম রয়েছে এক নম্বরে।
নলগাঁও গ্রামের বড় ঠিকাদার নাজমুল শিকদার এবং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা ও গাজীপুরের এমআইএসটির ছাত্র ফাহিম আহাম্মদকেও কৃষক হিসেবে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
একই গ্রামের সুমন শিকদার সরকারি চাকরিজীবী। তিনি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে শ্রীপুরে কর্মরত। তালিকায় তার নামও রয়েছে।
সুমন শিকদার বলেন, আসলে আমার নেওয়াটা ঠিক না। নিলাম তখন করোনাকাল। ভাবলাম সবজি-টবজি করি।
দুর্গাপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার (ফুলবাড়িয়া) আবদুল মোতালিব ও ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার (দেইলগাঁও) হযরত আলীও তালিকায় নাম লিখিয়ে সহায়তা নিয়েছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপকারভোগী নির্বাচনে ক্ষুদ্র কৃষকের বদলে সম্পদশালীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। টোকের ডুমদিয়া গ্রামের মোজাম্মেল হোসেন ও সিংহশ্রীর বড়বের গ্রামের নুরুল ইসলামের মত অনেকে ১০-২০ বিঘা জমির মালিক হয়েও তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
সহায়তা উপকরণ কি কি দেওয়া হবে, বেশির ভাগ ব্যক্তি তা জানেন না। সবজি পুষ্টি বাগানের সংখ্যাও কম। প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা-ও ঠিকমত তদারকি করা হয়নি।
এ ছাড়া সিংহশ্রীর ঝাউয়াদী গ্রামের মজিবুর রহমান, কুড়িয়াদীর আনহার আলী, তোফায়েল আহম্মেদ ও কড়িহাতার আনজাব ব্লকের হেলেনা খাতুনের নামের নিচে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর চারটি ভুল। কোনটিতে ডিজিট কম, কোনটিতে বেশি।
সিংহশ্রীর ভিটিপাড়া গ্রামের রুস্তম আলী, নয়ানগরের আতিকুল ইসলাম, আবদুল্লাহ ও বারিষাবরের নরোত্তমপুর গ্রামের মালেকের কোন মোবাইল নম্বর উল্লেখ নেই। এ ধরনের অনিয়ম আরও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা প্রথমে তালিকা তৈরি করেন। পরে তা উপজেলা কৃষি পুনর্বাসন কমিটি চূড়ান্ত করে। বিতরণ প্রক্রিয়ায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার দায় রয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার বসাকের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি আলোকিত নিউজকে বলেন, আপনি আমাকে তথ্য দেন, তদন্ত করব। আমার জানামতে প্রত্যেকের নম্বরে সমান টাকা দিয়েছি।
বিষয়টি প্রকল্পের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমত আরাকে জানালে তিনি আলোকিত নিউজকে বলেন, আপনারা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। আমি ব্যবস্থা নিব।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মাহাবুর রহমান ও হাসিব খান)