কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজে লুটপাট : অধ্যক্ষ ছানাউল্লাহ এখন কোটিপতি!

নিজস্ব প্রতিবেদক : কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজে অনিয়ম-দুর্নীতির চর্চা থেমে নেই। নানা কৌশলে সক্রিয় দুর্নীতিবাজ চক্র। ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। প্রশাসনের যথাযথ তদারকি না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।

কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৫ সালে এর উদ্বোধন করেছিলেন প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কিন্তু দুর্নীতির রাহুগ্রাসে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার ভিত্তি যেমন দুর্বল হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে সুনাম।

কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজে অতীতেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু বর্তমান অধ্যক্ষ ও সদ্য সাবেক হওয়া সভাপতির তুঘলকি কান্ড সব ছাপিয়ে এখন আলোচনার শীর্ষে।

একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবকের সাথে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে জানা যায়, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. ছানাউল্লাহ আগে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। বাস করতেন কলেজ রোডের পাশে আধা পাকা বাড়িতে। অধ্যাপক ছানাউল্লাহ ও অধ্যক্ষ ছানাউল্লাহর মধ্যে এখন বিস্তর ফারাক। দুর্নীতির অবাধ চর্চা পাল্টে দিয়েছে তার জীবনধারা। টিনশেড বাড়ির জায়গায় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে চারতলা বাড়ি। আয়-উপার্জনের ভিন্ন কোন খাত না থাকায় নানা প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে।

মো. ছানাউল্লাহ ২০১২ সাল থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন। দায়িত্ব পেয়েই তিনি পকেট ভারীর ফন্দি আঁটেন। পরিচালনা পর্ষদের সাথে আঁতাত করে শুরু হয় বাণিজ্য।

কলেজের অভ্যন্তরীণ বার্ষিক আয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। অথচ উন্নয়ন তথা ব্যয়ের খাতের বার্ষিক বাজেট ঘোষণা করা হয় না। আর্থিক স্বচ্ছতা রক্ষায় অডিটও হয় না। আয়-ব্যয়ের হিসাব গভর্নিং বডির সভায়ও উপস্থাপন করা হয় না। অর্থ আত্মসাতের জন্য এমনটি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।

গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় বাবদ কয়েক লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়। একাধিক শিক্ষকের অভিমত, ওই ব্যয়ের ভাউচার অস্বাভাবিক। কেননা ওই বছর ব্যয়ের তুলনায় কলেজের আয় অনেক কম হয়েছে।

২০১৩ সালের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের গাফিলতিতে বাদ পড়া ৩৮ জন এইচএসসি পরীক্ষার্থীর ফরম পূরণ করা হয়। এ জন্য ফরম পূরণের খাত থেকে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার কথা বলে দেড় লাখ টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

গত বছর থেকে একাদশ শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম ব্যাংকের মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ৮৪ জন বিলম্ব ফি দিয়ে ভর্তি হয়। ওই টাকা ব্যাংকে জমা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ভর্তিকৃতদের টাকার রসিদও দেওয়া হয়নি।

অনিয়ম চাপা : মো. ছানাউল্লাহ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজে ১৯৮৪ সালে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। তার সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনুপাতের নিয়ম মানা হয়নি। তিনি স্কেল দেখিয়ে অতিরিক্ত বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন। ২০০৪ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে এই অনিয়ম ওঠে আসে। তখন তাকে প্রায় দেড় লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে কিছু খরচ করে তা চাপা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

আরও অভিযোগ রয়েছে, মো. ছানাউল্লাহর প্রভাষক পদে নিয়োগের বিষয়টি রেজুলেশনভুক্ত ছিল না। ১৯৯১ সালে মন্ত্রণালয়ের অডিটে তা ধরা পড়ে। পরে তিনি রেজুলেশন বইয়ে নিজে লিখলেও ওই রেজুলেশন পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া তাকে শুধুমাত্র মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে অধ্যক্ষ করা হয়েছে। এতে দক্ষতার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্ব পেয়েছে।

তদন্ত কমিটি গঠন : কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা আগে পর্ষদের সদস্য ছিলেন। তিনি ২০০৪ সালে ‘ক’ তফসিলভুক্ত সরকারি জমি রেজিস্ট্রি দলিলমূলে বিক্রি করেন। দলিল নং ৬৬৯৮। যার দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয় কলেজের পশ্চিম পাশের জমি থেকে। আর ২০০৭ সালে গোপনে বিক্রি করা হয় ১৫ শতাংশ জমি। দলিল নং ৭৩৯০। যাতে কলেজের দাগ রয়েছে তিনটি।

এই ‘গুণধর’ ব্যক্তিই ২০১০ সালে সভাপতি হন। ২০১১ সাল থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিক্রীত ও বেদখল হওয়া প্রায় সাড়ে তিন একর জমির খাজনা। এরপর ২০১২ সালে অধ্যক্ষ মো. ছানাউল্লাহর প্রস্তাবে তিনি দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত হন। তাকে সভাপতি পদে আবারও ধরে রাখতে ইতিপূর্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি ১৪-এর (ক) অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি কলেজের স্বার্থবিরোধী বা সুনাম নষ্টমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করলে সেই ব্যক্তি গভর্নিং বডিতে থাকার অযোগ্য।

অভিযুক্তদের লুটপাটের ওপর গত ৯ সেপ্টেম্বর ও ১০ অক্টোবর দৈনিক সবুজ বাংলাদেশ-এ দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে চলে ব্যাপক তোলপাড়। অতঃপর কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়। আটকে যায় মোতাহার হোসেন মোল্লাকে সভাপতি করার প্রস্তাব। অভিযোগ তদন্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ড. আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্তও শেষ করেছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মোতাহার হোসেন মোল্লা পদ ধরে রাখতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। স্থানীয় সাংসদ তাকে ডিও লেটার দিয়েছেন বলেও প্রচার শুরু হয়েছে।

আরও খবর