গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য, কর্তৃপক্ষ নীরব
আলোকিত প্রতিবেদক : পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি নতুন আর কী, সারা বছরই তো চলে! ভাগ তো ওপরে যায়, ব্যবস্থা নেবে কে?
গাজীপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সেবা নিতে এসে ঘুষ-দুর্নীতির শিকার কয়েকজন ব্যক্তি এভাবেই খেদোক্তি প্রকাশ করলেন।
সরেজমিনে জানা যায়, গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসে কয়েক মাস ধরে ব্যাপক ভিড় হচ্ছে। বিদেশ যেতে ইচ্ছুক তরুণ ও যুবকরা সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদন জমা ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিচ্ছেন। আবেদন জমার লাইন মাঝে-মধ্যে দীর্ঘ হয়ে অফিসের বাইরে চলে যায়।
পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে রয়েছে দালাল চক্র। অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে দালালদের সাথে মিলেমিশে বাণিজ্য করছেন।
পাসপোর্ট অফিসের নিচ তলায় আবেদন জমা দেওয়ার কাউন্টার। সেবাপ্রার্থীরা সেখানে আবেদন জমা দিতে গেলে নানা ভুল-ত্রুটি ধরে ফেরত দেওয়া হয়।
পরে আবেদনকারীরা দালালদের কাছে যান। তাদের দাবিকৃত টাকা দিলেই বিশেষ সংকেত ব্যবহারের মাধ্যমে আবেদন গ্রহণ করা হয়।
সংকেত কোথায় থাকে : ট্যাংকির পাড় মোড়ের টেন্যান্সি ভবন থেকে পাসপোর্ট অফিস পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বেশ কিছু কম্পিউটারের দোকান রয়েছে। দোকানগুলোতে প্রথমে অনলাইন আবেদন ফরম পূরণ ও ব্যাংকে সরকারি ফি জমা দেওয়ার কাজ করা হয়।
বেশির ভাগ দোকান দালালদের একেকটি চেম্বার। আবেদনের ৭৬ নম্বর কলামে সংশ্লিষ্ট দালালের নাম বা ছদ্মনামের একটি ই-মেইল উল্লেখ থাকে। বর্তমানে এটাই সংকেত।
আবেদনকারীরা কাউন্টারে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা আগে পাতা উল্টিয়ে সংকেত আছে কি না দেখেন। সংকেত থাকলে সব ঠিক, না থাকলে ভুল ধরে ফেরত দেওয়া হয়।
কোন আবেদনে কত ঘুষ : নতুন বা নবায়ন সংক্রান্ত সাধারণ আবেদনে এক হাজার টাকা, জন্ম তারিখ পরিবর্তনের আবেদনে ছয় হাজার টাকা ও জন্ম নিবন্ধন দিয়ে ১৮ বছরের কম বয়সীদের আবেদনে দুই হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। দালালরা অফিস সময় শেষে কর্মচারীদের হাতে টাকা বুঝিয়ে দেন।
মাসে বাণিজ্য কোটি টাকা : গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসে কয়েক মাস ধরে দৈনিক গড়ে ৫০০-৭০০ আবেদন জমা হচ্ছে। ব্যক্তি বিশেষের কিছু আবেদন বিনা ঘুষে নেওয়া হয়। বাকিগুলো থেকে দৈনিক কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা হিসাবে মাসে আদায়কৃত ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় এক কোটি ১০ লাখ টাকা। পদ অনুযায়ী তা ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
বেশ কয়েকজন সেবাপ্রার্থী আলোকিত নিউজকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া কাজ হয় না-এটা ওপেন সিক্রেট। দালাল ধরতে বাধ্য করার কারণে অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে। তারা অফিস খরচের বাইরে কাজভেদে এক হাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরিমাণে টাকা নেন।
সরকারি প্রকল্পের আইটি ট্রেইনার সুজন বিশ্বাস নগরীর ছায়াবীথিতে থাকেন। তিনি পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করতে গেলে ম্যারিজ সার্টিফিকেট চাওয়া হয়। পরে দালাল ধরে দেড় হাজার টাকা দিলে আর কিছুই লাগেনি।
সুজন বিশ্বাস আলোকিত নিউজকে বলেন, আমার আগের পাসপোর্টে বৈবাহিক অবস্থা সিঙ্গেল ছিল। এখন বিবাহিত হওয়ায় আবেদনে ম্যারিড উল্লেখ করে কোর্টের অ্যাফিডেভিট সংযুক্ত করি। এরপরও সার্টিফিকেটের কথা বলে আবেদন ফেরত দেওয়া হয়। হয়রানি এড়াতে দালালের শরণাপন্ন হই।
কী করছেন এডি : গাজীপুর পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান গত ২৪ মার্চ যোগদান করেছেন। এর আগে তিনি কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ছিলেন। তার দায়িত্বের গত সাত মাসে ঘুষ ও হয়রানির কোন পরিবর্তন হয়নি।
খোদ দালালরা বলছেন, বর্তমান এডি যোগদানের পর অফিস থেকে ঘুষের টাকা কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নেওয়া হচ্ছে। নিজেদের লোকের জন্য অনুরোধ করলেও রাখা হয় না। একজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন।
শ্রীপুরের রাজাবাড়ী ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের সুনীল চন্দ্র সরকার সৌদি আরবে থাকেন। তিনি ইতিপূর্বে দেশে থাকাকালীন সময়ে পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন।
পরে ব্যাক এন্ড ভেরিফিকেশনে আটকে গেলে তিনি এডি আনিসুর রহমানের সাথে দুবার দেখা করেন। কিন্তু এডি তাকে কোন সহযোগিতা করেননি। অবশেষে দালাল ধরে পাঁচ হাজার টাকা দিলে সব ঠিক হয়ে যায়।
সুনীল চন্দ্রের ভাগিনা সুজন বিশ্বাস আলোকিত নিউজকে বলেন, এডির সাথে দেখা করার সময় আমি মামার সাথে ছিলাম। এডি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন। রুম থেকে বের হওয়ার সময় এডি বলেন, এমনিতে হবে না, লোক ধরে করেন।
এ ব্যাপারে সহকারী পরিচালক আনিসুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে আলোকিত নিউজকে বলেন, অফিসে কোন দালাল নেই। আশেপাশে দোকানদারে ফরম পূরণ করে দেয়, মানুষকে হেল্প করে। দোকান বন্ধ হয়ে গেলে অনেক মানুষ পাসপোর্ট করতে পারবে না।