গাজীপুরের সাফারি পার্কে এসিএফ তবিবুরের ‘দোকান ও প্যান্ডেল বাণিজ্য’

আলোকিত প্রতিবেদক : গাজীপুরের শ্রীপুরের রাথুরা ও সদর উপজেলার পিরুজালী মৌজার প্রায় চার হাজার একর ভূমি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, শিক্ষা ও গবেষণা এবং চিত্তবিনোদনের জন্য ঢাকার কাছে পর্যটন শিল্পের বিকাশ পার্কটির অন্যতম উদ্দেশ্য।

এখানে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় তিন বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান।

তার সময়ে পার্কে বিস্তৃত নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে আলোকিত নিউজ ডটকম। আজ প্রকাশিত হল প্রথম পর্ব।

প্যান্ডেল বাণিজ্য : সাফারি পার্কের মেইন গেট থেকে উত্তর দিকে বাঘ ও সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্ট দুটি ইজারা নিয়েছে মেসার্স মাইছা এন্টারপ্রাইজ।

সিংহ পর্যবেক্ষণ রেস্টুরেন্টের সামনে আকাশমনি বাগানের ভেতরে দুটি প্যান্ডেল স্থাপন করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের আপ্যায়নে ভেতরে সুসজ্জিত চেয়ার-টেবিল। মঞ্চসহ প্রথমটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১২০ ফুট ও প্রস্থ ৩০ ফুট। দ্বিতীয়টির দৈর্ঘ্য ৩৫ ফুট ও প্রস্থ ২০ ফুট।

বাগানের ভেতরে দুই প্যান্ডেল

প্যান্ডেলের সুবিধার্থে কয়েকটি গাছ কাটা হয়েছে। বড় প্যান্ডেলের দক্ষিণ পাশে সম্প্রতি কাটা আকাশমনি গাছের তিনটি ও পূর্ব পাশে একটি গজারি গাছের মোথা দেখা গেছে। পুরনো দেখাতে একটি আকাশমনি গাছের মোথায় আগুন দেওয়ার চিহ্নও রয়েছে।

রেস্টুরেন্টটির দক্ষিণ পাশে বাগানের ভেতরে চারটি মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে চলে রান্নাবান্না। এ যেন পিকনিকের স্পট!

বাঘ পর্যবেক্ষণ রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা গেল, রেস্টুরেন্টটির পূর্ব পাশে লাকড়ির স্তূপ। বাগানের ভেতরে দুটি চালা তুলে ও উন্মুক্ত স্থানে কয়েকটি মাটির চুলায় বড় বড় ডেকচিতে চলছে রান্নার কাজ। আগুনের তাপ ও ধোঁয়ায় গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাঘ রেস্টুরেন্টের পাশে বাগানে রান্নাবান্না

ইজারার চুক্তিপত্রের শর্ত বলছে, ইজারাদার রেস্টুরেন্টের সন্নিকটে বা বাইরের উন্মুক্ত স্থানে বাণিজ্যিক উদ্দেশে কোন প্রকার ভাসমান দোকান, সামিয়ানা টানানো, চেয়ার-টেবিল স্থাপন কিংবা পণ্য বিক্রয় করতে পারবেন না। শর্ত ভঙ্গ করলে কার্যাদেশ বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরো উল্টো। ইজারাদার শর্ত ভঙ্গ ও দীর্ঘদিন ধরে বনের ক্ষতিসাধন করে ব্যবসা করলেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাইছা এন্টারপ্রাইজের মালিক আকরাম হোসেন ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে রেস্টুরেন্ট দুটি পরিচালনা করছেন। তিনি এসিএফ তবিবুর রহমানকে ম্যানেজ করে প্যান্ডেল নির্মাণসহ ক্ষতিকর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে আকরাম হোসেন আলোকিত নিউজকে বলেন, রেস্টুরেন্টের ভেতরে ১০০ জন বসতে পারে। এর বেশি হলে বসার জায়গা তো দিতে হবে। এ জন্য প্যান্ডেল করা হয়েছে।

বাইরে রান্না প্রসঙ্গে বলেন, রেস্টুরেন্টের ভেতরে রান্নার ব্যবস্থা নেই। রান্না করে তো খাওয়াতে হবে। করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

দোকান বাণিজ্য : শিশু পার্কের সামনের আকাশমনি বাগানে ত্রিপল দিয়ে খাবার ও পানীয় বিক্রির একটি দোকান দেখা গেল। সাথে পৃথক সাতটি টেবিল ঘিরে চেয়ার স্থাপন। ভিড় করছেন ক্রেতারা।

শিশু পার্কের সামনে দোকান

দর্শনার্থী বাড়াতে দোকানের দক্ষিণ পাশে বাগানের ভেতরে একটি বড় হাতি বেঁধে রাখা হয়েছে। দেখভালের দায়িত্বে দুজন বন কর্মচারী।

দোকানটির মালিক পরিচয়ে মোর্শেদ জানালেন, এই দোকান ফুড কোর্ট-২ থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি এসিএফ তবিবুর রহমানকে বলে হাতি এখানে এনেছেন।

ফুড কোর্ট-১-এ গিয়ে দেখা গেল, সামনের বৃহৎ অংশজুড়ে পৃথক ১৬টি টেবিল ঘিরে চেয়ার স্থাপন। সাথে রয়েছে বিসমিল্লাহ চটপটি ও ফুসকা নামের একটি দোকান।

ফুড কোর্ট-১-এ চেয়ার-টেবিলের ছড়াছড়ি

দর্শনার্থীদের জন্য নির্মিত ছাতা আকৃতির স্থাপনাও তাদের দখলে। ফুড কোর্টের পাশে রাস্তার সাথে আরও একটি অস্থায়ী দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফুড কোর্ট-১ ইজারা নিয়েছে মেসার্স জুনায়েদ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির অংশীদাররা এসিএফ তবিবুর রহমানকে ম্যানেজ করে এসব বাণিজ্য করছেন।

জানতে চাইলে অংশীদার আজহারুল ইসলাম আলোকিত নিউজকে বলেন, সামনে জায়গা আছে বিধায় তারা দোকান বসিয়েছেন। নীতিমালা ধরে সবকিছু পারা যায় না।

তিনি আরও বলেন, জুনায়েদ এন্টারপ্রাইজের মালিক আবদুল কাদির। তার বাড়ি পার্কের সামনে। তারা কাদিরের লাইসেন্স দিয়ে ব্যবসা করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা আলোকিত নিউজকে বলেছেন, পার্কে নিয়মের বাইরে একটি সাধারণ দোকান দিলে এসিএফ তবিবুর রহমানকে এক বছরের জন্য দুই-তিন লাখ টাকা দিতে হয়। বড় কাজে লেনদেন বেশি। তার অনুমতি ছাড়া ইজারাদার বা অন্য কারও পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।

এ ব্যাপারে এসিএফ তবিবুর রহমান আলোকিত নিউজকে বলেন, রেস্টুরেন্টের সামনে প্যান্ডেল করা নীতিমালায় নেই। ঠিকাদার দুটি রেস্টুরেন্টের মধ্যে একটি চালায়, আরেকটিতে মাঝে-মধ্যে কিছু প্রোগ্রাম করে।

বাগানের ভেতরে রান্নাবান্না প্রসঙ্গে বলেন, বনের ক্ষতি নেই। কিন্তু এখানে রান্নাবান্না করা উচিত না। পার্কের ভেতর থেকে রেস্টুরেন্ট বাইরে নিয়ে যাওয়া দরকার। এটা আমি চাচ্ছি।

ফুড কোর্টের আশপাশে দোকান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সামনে টেন্ডারের তারিখ আছে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : আলোকিত নিউজে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে কিছু ধান্ধাবাজের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। এদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা সতর্ক থাকুন।

আরও খবর