কাপাসিয়ার পাকিয়াবরে গাছ পাচার, বন কেটে প্লট বাণিজ্য!
আলোকিত প্রতিবেদক : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই গজারি বন। সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে যা এত দিনে প্রকাণ্ড বনে পরিণত হওয়ার কথা।
কিন্তু দীর্ঘকালের অবহেলায় তা আজ সংকুচিত হচ্ছে। বয়সের হিসাবে নেই বড় বড় গাছের সারি। আছে লাখ লাখ কপিচ ও ছোট গাছের সমারোহ।
আলোচিত বনটি হচ্ছে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার পাকিয়াব বন। যা তরুলের বন নামেও পরিচিত। তিন হাজার ৬৬৭ একর আয়তনের এই বন ঢাকা বন বিভাগের শ্রীপুর রেঞ্জের গোসিংগা বিটের অধীন।
বনের কাছেই দীঘিরকান্দা এলাকায় রয়েছে সাব-বিট অফিস। তবে জরাজীর্ণ এই অফিসে কোন চেয়ার-টেবিল ও কর্মচারীর দেখা মেলেনি। ভেতরে আবর্জনা ও উইপোকার মাটির স্তূপ।
সম্প্রতি টোক-কাপাসিয়া রোডের বড়হর এলাকার মজিদ মোল্লা মাদ্রাসার পূর্ব দিক দিয়ে গভীর বনে ঢুকতেই বন উজাড়ের দৃশ্য চোখে পড়ল। রাস্তা সংলগ্ন দক্ষিণ ও উত্তর পাশে কেটে নেওয়া গাছের মোথার ছড়াছড়ি।
প্রায় দুই বিঘা বনভূমি থেকে প্রায় ২০০ গজারি গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। কিছু গাছের মোথা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনা ঢাকতে দক্ষিণ অংশে কিছু আকাশমনি গাছের চারাও রোপণ করা হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, কতিপয় পাচারকারী অবাধে গাছ পাচার করছে। ওই গাছগুলো গত ঈদুল আজহার আগে গভীর রাতে কেটে পাচার করা হয়েছে।
সাব-বিট অফিসের কাছে সালাম সিকদারের টেকে গিয়ে জানা যায়, সেখানে বন ঘেঁষে সালাম সিকদারের প্রায় দেড় বিঘা জোত জমিতে গজারি বন ছিল। চলতি বছরের প্রথম দিকে তিনি গাছ বিক্রি করে দেন। পরে ডিমারকেশন ও পারমিট ছাড়াই কয়েক শত গাছ কেটে নেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানান, সালাম সিকদারের বন কাটতে গিয়ে পাচারকারীরা সংরক্ষিত বনের অনেক গাছ কেটে নিয়েছে। এসব ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও বিট অফিস নীরব ছিল।
গত ঈদের আগে সিকদারের টেকের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আরও গাছ কাটা হয়। খবর পেয়ে বিট অফিস বেশ কিছু গাছ জব্দ করে নিয়ে যায়। কিন্তু এবারও পাচারকারীরা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সিকদারের টেকের পূর্ব পাশে পেঁচুরদিয়া এলাকা। সেখানকার রাস্তা সংলগ্ন গজারি বন বিক্রি করেন ইসলাম উদ্দিন। পরে পারমিট ছাড়াই প্রায় অর্ধশত গাছ কেটে নেওয়া হয়।
কয়েক কিলোমিটার ঘুরে দেখা গেল, বনের ভেতরে অসংখ্য রাস্তা। ট্রাক ও পিকআপ চলাচলের চিহ্ন অনেক। বানরসহ বন্যপ্রাণীর বিচরণও অনেক কম।
একাধিক স্থানে দেখা গেছে বর্জ্যের স্তূপ। মজিদ মোল্লা মাদ্রাসার পূর্ব-দক্ষিণ স্পটে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে কিছু গাছ।
অপরদিকে আকাশমনি প্লটের নামে বিঘার বিঘা গজারি বন উজাড় করা হচ্ছে। বড়হর নতুন বাজার থেকে পূর্ব দিকে বিলুর টেক, পংকিরমার টেক, কুমিল্লার টেক ও ভুতুইম্মার টেকসহ কয়েকটি স্থানে গাছ কেটে বিপুল পরিমাণ বন উজাড় করা হয়েছে।
উজাড়কৃত বনভূমিতে আকাশমনি চারা রোপণ করে বিভিন্নজনকে উপকারভোগী হিসেবে প্লট দেওয়া হচ্ছে। এতে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হচ্ছে।
এ ছাড়া ছোট-বড় ও কপিচসহ কর্তনকৃত হাজার হাজার গাছ নিলামে বিক্রি করা হয়নি। কয়েকজন মিলে আত্মসাৎ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিট কর্মকর্তা বিপ্লব হোসেন ও সিদ্দিকুর রহমান দায়িত্বে থাকাকালে লুটপাট বেশি হয়েছে। বিপ্লব হোসেন এখন জেলার রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের সালনা বিটে আছেন।
তাদের স্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করেছেন আলোচিত গাছ পাচারকারী মৈশন এলাকার মৃত সাদির মুন্সির ছেলে বাবুল। বড়হর নতুন বাজারে তার কাঠের দোকান রয়েছে।
তিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অবৈধভাবে গাছ কেটে ট্রাকযোগে বিভিন্ন স্থানে পাচার করছেন। তার সাথে আরও দুজন রয়েছেন।
এলাকাবাসী জানান, বাবুল ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়ার কথা বলে নিজে উপস্থিত থেকে বন উজাড় করাচ্ছেন। তিনি প্রতি একর প্লটে নেন ৫০-৯০ হাজার টাকা। পরে বিট অফিস তার কাছ থেকে টাকা বুঝে নেয়।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত বাবুল আলোকিত নিউজকে বলেন, ওই টেকগুলোতে গজারি গাছ ছিল না, ফাডা গুটা গাছ ছিল। যাদেরকে প্লট দেওয়া হয়েছে, তারা টাকা দেননি, চারা ও বাঁশের খরচ দিয়েছেন।
সালাম সিকদারের টেক ও বন থেকে গাছ পাচারের সময় বিট কর্মকর্তা ছিলেন বিপ্লব হোসেন। তার সাথে পাচারকারীদের বেশ সখ্যতা ছিল।
একজন প্রতিবাদকারী জানান, সম্প্রতি বদলি হওয়া ডিএফও মোহাম্মদ ইউছুপকে তিনি গত বছর ভিডিও কলে বন লুটপাটের চিত্র দেখিয়েছিলেন। কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, গাছ কাটে একজন, প্রতিবাদ করলে মামলায় ফাঁসে আরেকজন। ফরেস্টার সিদ্দিকের আমলে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে বর্তমান বিট কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম আলোকিত নিউজকে বলেন, মজিদ মোল্লা মাদ্রাসার পূর্ব দিক থেকে তার যোগদানের আগে গাছ কাটা হয়ে থাকতে পারে। তারপরও তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
তিনি আরও বলেন, সাব-বিট অফিসে স্টাফ দুজন। অফিসটি নতুন করে করার প্ল্যান পাস হয়েছে।
ফরেস্টার বিপ্লব হোসেনের সময় থেকে সাব-বিট অফিসে আছেন বোটম্যান রফিকুল ইসলাম। তার বাড়িও পাশের সনমানিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণগাঁও এলাকায়।
তিনি আলোকিত নিউজের কাছে দাবি করেন, সালাম সিকদারের টেকের জোত থেকে ১২-১৪টি গাছ রাতে কেটে নিয়েছে। বনের একটি গাছও কাটা হয়নি।
প্লট প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম বলেন, এসব তার আগে হয়েছে। যারা পেয়েছেন, তারা প্রভাবশালী। বাবুল ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক শাল কপিচ প্লট আছে।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, সংঘবদ্ধ চক্রের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে পাকিয়াব বন আজ হুমকির মুখে। বন রক্ষায় জড়িতদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
তারা আরও বলেন, বনের ভেতরে যত্রতত্র রাস্তা থাকায় পাচারকারীদের সুবিধা হচ্ছে। জনসাধারণের চলাচলের সাধারণ পথ রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত।