বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লীলাভূমি
অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন : বাংলাদেশ পৃথিবীর এক প্রাচীন জনপদ। এ দেশের মাটি ও পরিবেশ স্বর্ণগর্ভা। এখানে জন্ম নেওয়া মানুষ প্রাকৃতিকভাবে অনেক উদার ও বন্ধুবৎসল।
বাংলাদেশ সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য সূতিকাগার। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির লীলাভূমি। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার পাশাপাশি অবস্থান।
হাজার বছর ধরে এখানে পবিত্র ইসলাম ও সনাতন ধর্মের অনুসারীরা একত্রে বসবাস করে আসছেন। ধর্ম পৃথক হলেও সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত সবাই।
ঈদ, পূজা, বাংলা নববর্ষের উৎসব পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ আদিকাল থেকে যেন প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শারদীয় দুর্গোৎসব পালনে সহযোগিতা করেন মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন। একজনের ব্যথায় আরেকজন ব্যথিত হন। সুখে হন আনন্দিত।
এখানে গোরস্থান, শ্মশানে সমবেদনা জানাতে আসার দৃশ্য অতি পরিচিত। প্রিয়জন হারানোর ব্যথায় চোখের কোণে পানি জমে। স্বজন হারানোর আবেগ সাঁতার কাটে হৃদয়ের গভীরে। মৃত্যুতে, দাফনে, চেহলাম, শ্রাদ্ধে এগিয়ে আসেন সবাই।
এখানে শুভ বিবাহে হিন্দু-মুসলমানের সরব উপস্থিতি। যার যার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী খাবারের মেনু থাকে। আনন্দ-হাসিতে মেতে ওঠেন সবাই। কামার, কুমার, মুচি, মেথর, নরসুন্দরে নেই কোন ভেদাভেদ।
এখানে এক সাথে হেসে-খেলে বড় হয় হিন্দু-মুসলিম কিশোর-কিশোরী। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সাথে লেখাপড়া করে বড় হয়। প্রতিনিয়ত শ্রদ্ধা-মঙ্গল কামনায় হয় পরস্পর সালাম-আদাব বিনিময়। ক্ষুধা, দারিদ্র, শিক্ষা, চিকিৎসা কিংবা বিপদ-আপদে এগিয়ে আসেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।
বাংলাদেশের মাটির মানুষগুলো ঠিক যেন মাটির মত। পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক উন্নত। বলা যায়, বর্তমান বিশ্বে সম্প্রীতির রোল মডেল। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে মুসলমানের চেয়ে গরুর দাম অনেক বেশি।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের গৌতমবুদ্ধের অনুসারীরা নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ করছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছাই করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ তাদেরকে শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছে। দল-মত নির্বিশেষে সবাই দিন-রাত কাজ করছেন। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার।
মানবতাবোধ বাংলাদেশের মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। এত উদার প্রকৃতির মানুষ আমাদের প্রতিবেশী দেশের ভিন্ন ধর্মের নাগরিকরা হতে পারেনি। হতে পারবে বলেও মনে হয় না।
বাংলাদেশের মানুষের উদারতার এই সংস্কৃতি এক দিনে গড়ে ওঠেনি। এ দেশের হিন্দু-মুসলমান মিলে খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলন করেছেন। ভারতের মাটি থেকে ব্রিটিশ খেদাও সংগ্রাম করেছেন। জমিদারবিরোধী আন্দোলনে লড়েছেন এক সাথে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের গভীর ষড়যন্ত্র করেছে। তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লব করেছেন এক সাথে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন এ দেশের হিন্দু-মুসলমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সকলের সমান অধিকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।
আমাদের দেশে মসজিদের খুতবায় ইমামগণ ভ্রাতৃত্ব-সম্প্রীতির কথা বলেন। মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার পাদ্রিগণ সম্প্রীতির কথা বলেন। ওয়াজ, কীর্তন, আলোচনা সভায় সম্প্রীতির ভাষণ হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও সম্প্রীতির আলোকে সাজানো। এত মহতি উদ্যোগ ও কাজ করে যে দেশ, সে দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে তো বিশ্ব সেরা হবে, এটাই স্বাভাবিক।
অন্যে উদার হবে না বলে আমি উদার হব না, তা হতে পারে না। ওরা খারাপ বলে আমিও খারাপ হব, তা-ও প্রত্যাশিত নয়। কোন ধর্মের মানুষ আক্রান্ত হলে অন্য ধর্মের অনুসারীরা যদি তাদের পাশে দাঁড়ান, তাহলে সম্প্রীতি আরও জোরদার হবে। আর যদি অন্য ধর্মের লোকজন আক্রান্ত হয়েছেন বলে কেউ দূরে থেকে মৃদু হাসেন, তাহলে সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে।
আমরা এমনটা প্রত্যাশা করি না। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লীলাভূমি। এই পরিচয় নিয়েই বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে আপন মহিমায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন
সাধারণ সম্পাদক
কাপাসিয়া প্রেসক্লাব।
মোবাইল : ০১৭১৬-৩৩৩১৯১