কাপাসিয়ায় বনকে চালা দেখিয়ে লিজ, কাশেমের গাছ পাচার জমজমাট
আলোকিত প্রতিবেদক : গাজীপুরের কাপাসিয়ার তরগাঁও সরকারের ১ নং খাস খতিয়ান অধ্যুষিত অন্যতম ইউনিয়ন। কয়েকটি এলাকায় রয়েছে বিপুল পরিমাণ গজারি বন।
এই বনগুলো অতীত থেকে ভূমি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চালা জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে। কাগজপত্রে ভূমিহীন থাকলেও গ্রহীতাদের অনেকে সচ্ছল ও প্রভাবশালী হিসেবে দৃশ্যমান।
দেওনা কাচারি বাজার থেকে পশ্চিমে আশ্রয়ণ কেন্দ্র রাস্তা দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার এগোলে রাস্তা সংলগ্ন উত্তর পাশে অজির টেক। সেখানকার এসএ ৩৪০ নং দাগের চার বিঘা জমিজুড়ে ছিল গজারি গাছ।
একই এলাকার সরকারবাড়ির ইব্রাহীম গং ছোট-বড় প্রায় ৩০০ গাছ গজারি গাছের ব্যবসায়ী কাশেমের কাছে বিক্রি করে দেয়। পরে গত সেপ্টেম্বরে গাছগুলো অবৈধভাবে কেটে পাচার করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, টেকটিতে দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই গজারি বন ছিল। দখল সূত্রে বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু গাছ কাটা হচ্ছিল। বন্দোবস্ত গ্রহীতাদের মধ্যে মো. ইব্রাহীম হলেন ফকির সাহাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
এবার সব গাছ কেটে নেওয়ার ফলে বনটি এখন বিরানভূমি। ঘটনাটি কয়েক দিন ধরে ঘটলেও ইউনিয়ন ভূমি অফিস বা বন বিভাগের কেউ কোন ব্যবস্থা নেননি।
এ ব্যাপারে ইব্রাহীম মাস্টার আলোকিত নিউজকে বলেন, তারা গজারি বন ২০১১-১২ সালে সাতজনের নামে ৯৯ বছরের জন্য বন্দোবস্ত নিয়েছেন। গত বছর কাশেমের কাছে গাছ বিক্রি করা হয়। দুই-তিনটি গাছ কাটার পর এসিল্যান্ড ও নায়েব এসে বাধা দেন।
তিনি বলেন, এসিল্যান্ডের কথায় খারিজের আবেদন করা হয়েছে। তাদের বাড়ি থেকে বন দূরে। কাশেম হয়তো অফিসে কিছু যোগাযোগ করে গাছ কেটে নিয়েছেন।
আশ্রয়ণ কেন্দ্রের একটু উত্তরে গিয়ে পূর্ব পাশে গজারি বনের ভেতরে বড় মাঠ। এটা সিরাজ মেম্বারের টেক নামে পরিচিত।
মাঠের পূর্ব পাশের বনে সদ্য কেটে নেওয়া অন্তত ১২টি বড় গাছের মোথা চোখে পড়ল। মাঠ সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ও বনের ভেতরে পাওয়া গেল আরও কয়েকটি মোথা।
উপস্থিত কয়েকজন জানান, এসব খাস জমি আগে সিরাজ মেম্বারের দখলে ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর ছেলেরা আর আসে না।
এই সুযোগে ওই কাশেম রাতের বেলা গাছ কেটে পাচার করছেন। বড় গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
কে এই কাশেম : আবুল কাশেম অতীতে খুব দরিদ্র ছিলেন। তিনি এক সময় ভূলেশ্বর এলাকার প্রয়াত মফিজ উদ্দিন চেয়ারম্যানের টেকে ঘর উঠিয়ে পরিবার নিয়ে থাকতেন। পরে দেওনা আশ্রয়ণ কেন্দ্রে একটি ঘর পান।
এক পর্যায়ে কাশেম গাছ পাচারের লোভনীয় ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। আশপাশের কয়েক এলাকায় বিস্তার করেন আধিপত্য। তিনি জোতের গাছ কিনলেও পারমিটের ধার ধারেন না।
কাশেম এখন আর আশ্রয়ণ কেন্দ্রে থাকেন না। পাঁচ-ছয় বছর আগে বাঘিয়া এলাকার স্বাধীনতা মাঠ সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব পাশে পৌনে এক বিঘা সরকারি জমি দখল করেন। সেখানে নির্মাণ করা হয় বড় পাকা বাড়ি।
পাচারের শেষ নেই : আশ্রয়ণ কেন্দ্র থেকে দক্ষিণ দিকে বাঘিয়া রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলে অল্প পূর্ব পাশে দেওনা গড়পাড়া এলাকার আবদুস সোবহানের টেক। তিনি বন্দোবস্ত সূত্রে তিন বিঘা গজারি বনের কপিচসহ প্রায় এক হাজার গাছ কাশেমের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে গত অক্টোবরের শেষ দিকে গাছগুলো কেটে পাচার করা হয়।
বাঘিয়া উত্তরপাড়া এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে তিন বিঘা বনে কয়েক শত গজারি গাছ ছিল। চার-পাঁচ বছর আগে বন্দোবস্ত গ্রহীতা আবেদ আলী, আকবর আলী ও মৃত আবদুল আউয়ালের ছেলে কবির হোসেন বনটি কাশেমের কাছে বিক্রি করে দেন।
পরে গাছগুলো কেটে পাচার করা হয়। সেখানে পুনরায় গজিয়েছে হাজারো কপিচ। গাছগুলো উপযুক্ত হলে আবারও বিক্রি করা হবে বলে জানা গেছে।
গত ২১ নভেম্বর দুপুরে সোনারুয়া মধ্যপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, আটজন শ্রমিক দিয়ে পাকা রাস্তা সংলগ্ন তিন বিঘা গজারি বনের গাছ কাটা হচ্ছে। আলোকিত নিউজ টিমকে দেখে কাশেমের ছেলে আল-আমিন এগিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, এটা খাস নয়, জোত। তারা ইসমাইল হোসেন গংয়ের কাছ থেকে গাছ তিন লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন। তবে পারমিট করা হয়নি।
পরে আল-আমিন নিউজ না করার অনুরোধ জানান। রাতে তার বাবা ফোন করে কোন খাস কাটা হয় না বলে দাবি করেন।
ঘটনাটি সন্ধ্যায় শ্রীপুর রেঞ্জের গোসিংগা বিট কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামকে জানালে তিনি দেখবেন বলে জানান। কিন্তু ওই রাতেই গাছগুলো পাচার হয়ে যায়।
এলাকাবাসী বলছেন, কাশেম বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ গাছ পাচার করেছেন। যেভাবে উজাড় করা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে বন বলতে কিছু থাকবে না। সরকারের সম্পদ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
ধরা পড়েও ছাড়া : কাশেম ও তার ছেলে গাছ পাচার করতে গিয়ে একাধিকবার ধরা পড়েছেন। তবে তাদেরকে কখনো জেলে যেতে হয়নি।
গত মার্চে ভোররাতে মিয়ার বাজার এলাকা থেকে গজারি গাছবোঝাই একটি ট্রাক আটক করে পুলিশ। তখন কাশেমের ছেলে আল-আমিনসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।
পরদিন সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমত আরা তাদেরকে ২১ হাজার টাকা জরিমানা করে ট্রাকসহ ছেড়ে দেন। জব্দ গাছগুলো থানা থেকে নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের ভেতরে রাখা হয়।
এর আগে বাঘিয়া থেকে কাশেমের কর্তনকৃত প্রায় ১০০ গজারি গাছ আটক করেন ইউএনও ইসমত আরা। ওই ঘটনায় মামলা বা জরিমানা হয়েছে কি না, জানা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উপজেলা প্রশাসনের ভেতরে দুই কর্মচারীর নেতৃত্বে একটি দালাল চক্র রয়েছে। গাছ ধরা পড়লে তারা কৌশলে পাচারকারীদের রক্ষা করেন। কাশেমের বাড়ি উচ্ছেদ না হওয়ার পেছনেও চক্রটির হাত রয়েছে।
এদিকে সিরাজ মেম্বারের টেক থেকে গাছ পাচারের ঘটনাটি সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুবাইয়া ইয়াসমিনকে জানালে তিনি ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আক্কাস আলীকে দায়িত্ব দেন। পরে তিনি কর্মচারী সেলিমকে ঘটনাস্থলে পাঠালেও কিছুই হয়নি।
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, বন্দোবস্তকৃত বনের গাছ বিক্রি করলে নায়েবকে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হয়। নায়েবের সাথে কাশেমের সুসম্পর্ক রয়েছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আক্কাস আলী আলোকিত নিউজকে বলেন, সরকারি জমি থেকে কোন গাছ কাটা হয়নি। আমি জোত থেকে গাছ কাটতে দেখেছি।
আইনে শাস্তি থাকলেও প্রয়োগ নেই : খাস জমি বন্দোবস্ত নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, বন শ্রেণির খাস ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না। তা রাস্তা-ঘাট ও নদী-নালার মত সংরক্ষণ করতে হবে।
এ ছাড়া তথ্য গোপন করে বন্দোবস্ত দেওয়া হলে তা যে কোন সময় বাতিল ও দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।
আর বনজদ্রব্য পরিবহন (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০১১ অনুযায়ী, পারমিট ব্যতীত গাছ কাটা ও পরিবহন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ক্ষেত্রে পরিবহন কাজে ব্যবহৃত ট্রাকও সরকারের নামে বাজেয়াপ্ত করার বিধান রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মামুন সরদারের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি তা যাচাই করে দেখবেন বলে জানান।
আরও পড়ুন : কাপাসিয়ায় খাস বনের গাছ পাচার : ভূমি কর্মকর্তা নীরব
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আলোকিত নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক সাইফুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান সবুজ)