গাজীপুরের আকর্ষণীয় বেলাই বিলে নৌকা ভ্রমণ
অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য জনপদের নাম গাজীপুর। শাল, গজারি, মেহগনি, সেগুন বেষ্টিত এবং শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, বানার, তুরাগ বিধৌত গাজীপুর থেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ রচনা হয়েছিল।
এ জেলায় আছে জাতীয় উদ্যান। গাজীপুর জেলার অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে বেলাই বিল। চিলাই নদী থেকে বেলাই। বেলাই বিলকে নিয়ে রয়েছে নানা উপাখ্যান।
আমাদের দেশে যেসব বিল রয়েছে, এর মধ্যে বেলাই বিল রূপ-সৌন্দর্যে অনন্য। বিশাল বিলটির কোন কোন স্থানে প্রায় সারা বছর পানি থাকে। তবে বর্ষায় এর রূপ বেড়ে যায় অনেক।
বর্তমানে বিলটি আট বর্গমাইল এলাকায় বিস্তৃত হলেও এক সময় এটি আরও বড় ছিল। বাড়ীয়া, ব্রাহ্মণগাঁও, বক্তারপুর ও বামচিনি মৌজাঘেরা বেলাই বিল।
তবে ৪০০ বছর আগের ইতিহাসে বেলাই বিলে কোন গ্রামের অস্তিত্ব ছিল না। খরস্রোতা চিলাই নদীর কারণে বিলটিও খরস্রোতা স্রোতস্বিনীরূপে বিরাজমান ছিল।
কথিত আছে, ভাওয়ালের সেই সময়ের ভূস্বামী ঘটেশ্বর ঘোষ ৮০টি খাল কেটে চিলাই নদীর জল নিঃশেষ করে ফেলেন তার ছেলের সলিল সমাধির কারণে। তারপর এটি প্রকান্ড বিলে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে ছেলেরা ডাঙ্গি খনন করে। ধরা হয় মাছ।
আর শুষ্ক মৌসুমে বিলটি হয়ে ওঠে এক ফসলি জমি। তাতে চাষ হয় ধান। বেলাই বিলের নানা জাতের দেশীয় মাছ খেতে অনেক সুস্বাদু। বর্তমানে বেলাই বিলের কৃষক-জেলে-নৌকার মাঝিদের বিড়ম্বনা কচুরিপানা।
ভ্রমণপিপাসুদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে বেলাই বিল। ভরা বর্ষায় বেলাই বিলে নৌকা ভ্রমণ যেন অনাবিল আনন্দের ছোঁয়া। আর নৌকার ছাদে খোলা নীল আকাশের নিচে সঙ্গীতের সুরের মূর্ছনা কিংবা মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিজেকে রোমাঞ্চ করে দারুণভাবে।
বন্ধুবর অধ্যক্ষ হুমায়ূন কবিরের উদ্যোগে কয়েকবার আমার সৌভাগ্য হয়েছে বেলাই বিলে নৌকা ভ্রমণের। গাজীপুর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক ও সাংবাদিক হুমায়ূন আমার দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু। ছাত্রজীবন থেকে আমরা সাংবাদিকতার সাথে জড়িত। লেখালেখিও করেছি একই পত্রিকায়। দুজনই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।
আমাদের বন্ধুমহলে হুমায়ূন সবচেয়ে ভ্রমণ পাগল হিসেবে পরিচিত। তার প্রচেষ্টাতেই ভ্রমণের আয়োজন হয়। ভ্রমণের সুবাধে বন্ধুদের সাথেও দেখা হওয়ার সুযোগ হয়। এ কারণে হুমায়ূন অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
গত ১১ আগস্ট ২০১৭, কলেজ বন্ধের দিন। বেলাই বিলে নৌকা ভ্রমণের দাওয়াত পেলাম হুমায়ূনের কাছ থেকে। বৃহস্পতিবার থেকে অবিরাম বৃষ্টি। শুক্রবার সকালে বৃষ্টির বেগ যেন আরও বাড়ে। মোবাইলে হুমায়ূনের তাগাদা পেয়ে প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছাতা মাথায় কাপাসিয়ার বাসা থেকে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
পাবুর রোড থেকে সিএনজিতে করে ৪৫ মিনিটে হাড়িনাল। হাড়িনাল থেকে টমটমে করে তিতারকুল ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখি অনেক নৌকা থরে থরে সাজানো। আমাদের জন্য নির্ধারিত নৌকায় উঠলাম। অ্যাডভোকেট ফখরুল ভাই স্বাগত জানালেন।
নৌকাতে বসে অপেক্ষা করছিলেন টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ কর্মকর্তা এবং সাপ্তাহিক শুভ সকালের সম্পাদক শামসুল আলম শিবলী, সঙ্গীত শিল্পী শামীম আহমেদ, উপাধ্যক্ষ হারুন অর রশিদ, মনছবি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সিরাজ ভাইসহ অনেকে।
একটু পরেই হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে নৌকায় উঠলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিকের হাতে গড়া বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক মালিক আবদুল লতিফ ও ইসলামী সঙ্গীত শিল্পী আবুল আলা মাসুম।
সকাল ১১টায় তিতারকুল থেকে ৬০ জনের বহর নিয়ে নৌকা ছাড়া হয়। ক্ষুদে শিল্পীদের অংশগ্রহণ আমাদের ভ্রমণকে করে আনন্দময়। সেদিন বেলাই বিলে ভ্রমণ পাগলদের ঢল নেমেছিল।
আমরা কানাইয়া বাজারের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন জেলেরা মাছ ধরছিল। ছোট-বড় সেতুর ওপর থেকে শিশু-কিশোররা লাফ দিয়ে নিচে পড়ছিল। এ দৃশ্য দেখে ছোটবেলায় শীতলক্ষ্যায় লাফ দেওয়ার দৃশ্যগুলো মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছিল।
পূবাইল বাজারের কাছাকাছি গেলে জুমার নামাজের আজান হয়। আমরা বেলাইয়ের দ্বীপ পূবাইল বাজার জামে মসজিদে নামাজ আদায় করি। কচুরিপানা, শাপলা মাড়িয়ে নৌকা আবার সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আমাদের গন্তব্য মনছবির ‘বেলাই বিলাস ইকো রিসোর্ট’। অথৈ জলরাশির এক প্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছে এই স্পট। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য খুব আকর্ষণীয়।
নৌকা ভ্রমণের প্রধান আকর্ষণ ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নামাজের পর নৌকার ছাদে শুরু হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীদের দেশাত্মবোধক গান, কবিতা আবৃত্তি, ইসলামী সঙ্গীত, অভিনয় ও কৌতুক প্রতিযোগিতা। ছিল আকর্ষণীয় গিফট।
লেখক : অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন
সাধারণ সম্পাদক
কাপাসিয়া প্রেসক্লাব।
মোবাইল : ০১৭১৬-৩৩৩১৯১