কাপাসিয়ার সিংহশ্রীতে গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতি!

আলোকিত প্রতিবেদক : গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে হরিলুটের আরও তথ্য বেরিয়ে আসছে।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি আলোকিত নিউজ ডটকমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে চলে ব্যাপক তোলপাড়।

পরদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমত আরা ঘাগটিয়ার জাবর গ্রাম পরিদর্শন করলে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী পাল্টানো শুরু হয়।

তবে তিন দিন পর ই-মেইলে পাঠানো প্রতিবাদপত্রে তিনি প্রকাশিত সংবাদকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেন।

তদন্ত ছাড়াই বাস্তব চিত্র সরাসরি অস্বীকার করায় তার ভূমিকা নিয়েও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে প্রায় পৌনে ৪০০ গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প এ বরাদ্দ দিয়েছে। ঘরপ্রতি বাজেট এক লাখ টাকা।

বারান্দাসহ সাড়ে ১৬ ফুট দৈর্ঘ্যের টিনশেডে পাকা ভিটি। সাথে টয়লেট।

প্রকল্পটির আহ্বায়ক ইউএনও ও সদস্যসচিব পিআইও। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন কমিটিতে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানও সদস্য।

সিংহশ্রী ইউনিয়নে ৮৪টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আলোকিত নিউজের অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য।

পোনাশারী গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী খায়রুন্নেছা জানান, তাদের ঘরে এক লরি বালু দেওয়া হয়েছে। ২৪০০ টাকার বালু নিজেরা কিনে দিয়েছেন।

এ ছাড়া স্ক্রু ও বল্টুর জন্য দিয়েছেন ২০০ টাকা। দরজা ও জানালার কয়েকটি কাঠও তারা দিয়েছেন।

ঘরের ভেতরে দেখা যায়, কিছু কাঠ নিম্নমানের। খুঁটিগুলো দুর্বল। ফ্লোর ও বারান্দার অংশ অল্প অল্প করে ভেঙে যাচ্ছে।

রফিকুল দম্পতি বলেন, দুই নম্বর ইট ৬০০ পিস দেওয়া হয়েছে। বাজেট যে এক লাখ টাকা, তা আমরা জানি না।

ঝাউয়াদী তিতারটেকের ওসমান আলী ইটভাটার শ্রমিক। তার অনুপস্থিতিতে কথা বলেন স্ত্রী শামীমা আক্তার ও মা রাজিয়া পারভীন।

তারা জানান, এক লরি বালু ও আধা লরি রাবিশ খোয়া দেওয়া হয়েছে। ইট দুই নম্বর ও তিন নম্বর।

ঘরের ফ্লোর ও বারান্দায় ঢালাই দেওয়া হয়েছে এক ইঞ্চি। এখনই অল্প অল্প করে ভাঙা শুরু হয়েছে।

তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তালিকার সময় আজিজুল মেম্বারকে চার হাজার টাকা দিতে হয়েছে। সরকারের ভাল কাজে দুর্নীতি করবে কেন?

একই গ্রামের কমর উদ্দিনের স্ত্রী ও দুই ছেলে জানান, তাদের ঘরে বালু দেওয়া হয়েছে আধা লরি। দুই লরি বালু নিজেরা কিনে দিয়েছেন।

প্রথমে ইট তিন নম্বর ও পরে দেওয়া হয়েছে দুই নম্বর। ২০০ টাকার তারকাটাও তাদেরকে কিনতে হয়েছে।

তারা আরও বলেন, ঘরের ফ্লোরের অংশ অল্প অল্প করে ভেঙে যাচ্ছে। রায়েদের মোতাহার মেম্বার মালামাল দিয়েছেন।

বড়বেড়ের টমটম চালক আরিফ মৃধার বোন ও চাচা জানান, তাদের ঘরে ঢালাই দেওয়া হয়েছে দেড় ইঞ্চি। এক লরি বালু নিজেরা দিয়েছেন।

বড়বেড় নতুন বাজার এলাকার মৃত মহিউদ্দিন শেখের ছেলে মাহবুব আলম পোশাক কারখানার শ্রমিক। তিনি একটি ঘর পেয়েছেন।

তার মা ও বোন জানান, ঘরটিতে এক লরি বালু দেওয়া হয়েছে। ২৬০০ টাকার বালু নিজেরা কিনে দিয়েছেন। রাস্তা থেকে মালামাল আনায় খরচ হয়েছে আরও ১৫০০ টাকা।

এক-দেড় ইঞ্চির ঢালাইয়ে ফ্লোরের কিছু অংশ অসমতল। খোয়া আধা লরিরও কম দেওয়া হয়েছে।

বড়বেড় দক্ষিণপাড়ার কৃষক কমর উদ্দিন মৃধা জানান, তাদের ঘরে বালু দেওয়া হয়েছে এক লরি। দুই ভ্যান বালু নিজেরা কিনে দিয়েছেন।

খোয়া দেওয়া হয়েছে আধা লরি। টিনের বেড়ার নিচের অংশ ফাঁকা থাকায় বৃষ্টি হলেই পানি ভেতরে ঢোকে।

এ ছাড়া মাটির নিচে কোন ইট না দিয়ে ওপর থেকে বসানো হয়েছে। ফলে ইট ক্রমান্বয়ে সরে ঘর নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তাদের টয়লেটের ছয়টি রিং পড়ে আছে প্রতিবেশী আফতাব উদ্দিন মৃধার বাড়ির পাশে। একটি ভেঙে গেছে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আফতাব উদ্দিন মৃধা বলেন, এগুলো নিম্নমানের। দেখলেই বোঝা যায়।

একই গ্রামের নয়ন কবির মৃধা জানান, ইট দেওয়া হয়েছে দুই নম্বর। তারা নিজেরা দুই লরি বালু কিনে দিয়েছেন।

আধা লরি খোয়া ও ভিটি বালু দিয়ে ঢালাই করা হয়েছে এক ইঞ্চি। বারান্দার চালায় বল্টু ও স্ক্রুর কাজ অসম্পন্ন রয়েছে।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইট মাটির ওপর থেকে বসানো হয়েছে। বৃষ্টিতে ইট সরে ঘর নষ্ট হবে। আমরা দুর্নীতির বিচার চাই।

প্রতিবেশী হেলেনা আক্তার জানান, তারা দুই লরি বালু ১৮০০ টাকায় কিনে দিয়েছেন। ঘরের বেড়ায় টিন কম দেওয়ায় কয়েকটি ফাঁক রয়েছে।

ঘরটির পেছনের জমি নিচু। ইট মাটির ওপর থেকে বসানোর কারণে একাধিক ফাটল দেখা দিয়েছে।

গাঁথুনি ও ঢালাইয়ে কারচুপি : ইস্টিমেট অনুযায়ী, মাটির নিচ থেকে প্রায় দুই ফুট ইটের গাঁথুনি ও ফ্লোরে তিন ইঞ্চি ঢালাই দেওয়ার কথা। কিন্তু কোন কোনটিতে মাটির নিচে এক ইট দিলেও ঢালাই দেড় ইঞ্চির বেশি দেওয়া হয়নি।

টয়লেটে কারচুপি : ইস্টিমেট অনুযায়ী, টয়লেটের রিং দেওয়ার কথা আটটি। কিন্তু দেওয়া হয়েছে ছয়টি। দুটি কম দিয়ে বাড়িপ্রতি আত্মসাত করা হয়েছে ৬০০ টাকা।

এ ছাড়া কোন টয়লেটের কুয়া দেড় ফুট, কোনটির চার ফুট, আবার কোনটির কুয়া খোঁড়া হয়নি। দেওয়া হয়নি স্লাব ও ঢাকনা।

রিংগুলো গত দেড়-দুই মাস ধরে পড়ে রয়েছে। বাকি কাজ হবে কি না, তা কেউ বলতে পারছেন না।

ইট ও খোয়ায় কারচুপি : ইস্টিমেট অনুযায়ী, এক নম্বর ইট ও পিকেট খোয়া দেওয়ার কথা। কিন্তু খোয়া কম অর্থাৎ আধা লরিতে ৪০-৪৫ ফুট দেওয়া হয়েছে।

তা-ও আবার নিম্নমানের। রায়েদ বাজার এলাকার এএমকে ভাটার ইট ব্যাপক হারে ব্যবহার হচ্ছে।

জানালায় কারচুপি : ইস্টিমেট অনুযায়ী, ঘরে জানালা দেওয়ার কথা চারটি। কিন্তু দেওয়া হয়েছে দুটি। রংও করা হয়নি। এতে ঘরপ্রতি ৭০০ টাকার বেশি আত্মসাত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউনিয়নটিতে প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। ৮৪ লাখ টাকার কাজে অন্তত ৩৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ধামাচাপা কাহিনি : আলোচিত দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে নানা তৎপরতা শুরু হয়েছে। দালাল হিসেবে পরিচিত এক সাংবাদিক ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় গুণকীর্তন প্রকাশের ঠিকাদারি নিয়েছেন।

তা ছাড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বাকি বিল্লাহ ও সহকারী প্রকৌশলী উত্তম কুমার উপকারভোগীদের সন্তুষ্টির কথা শিখিয়ে ভিডিও ডকুমেন্টারি করছেন।

সচেতন মহল বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই মানবিক প্রকল্পে গরিব মানুষ যেখানে মানসম্মত ঘর পাওয়ার কথা, সেখানে দুর্নীতির দুঃসাহস দেখানো কর্মকর্তাদের কোনক্রমেই ছাড় দেওয়া উচিত নয়।

আরও খবর