কাপাসিয়ায় ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে’ কোটি টাকা লুট!

আলোকিত প্রতিবেদক : গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গরিবের গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে হরিলুট অবশেষে ধামাচাপা পড়েছে।

প্রকল্পটির তিন কোটি ৭২ লাখ টাকার কাজে অন্তত এক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

প্রধান অভিযুক্ত উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বাকি বিল্লাহকে ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ে বদলি করেই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ।

তবে তার অন্যতম সহযোগী সহকারী প্রকৌশলী উত্তম কুমার এখনো কাপাসিয়ায় আছেন বহাল তবিয়তে।

আরও পড়ুন : কাপাসিয়ায় গৃহ নির্মাণে হরিলুট : পিআইও বদলি, উত্তম বহাল!

গত ৪ ফেব্রুয়ারি আলোকিত নিউজ ডটকমে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাবেক জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরের নির্দেশে তদন্ত হয়।

তদন্তে সাবেক আরডিসি জান্নাতুল ফেরদৌস (বর্তমানে জেএম শাখা) প্রকৃত চিত্র এড়িয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বললে তিনি সাক্ষী পাওয়া যায়নি বলে অজুহাত দাঁড় করান।

অথচ প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে কারচুপির বেশ কয়েকটি ছবি ও ইস্টিমেটের বর্ণনা দিয়ে ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে।

আরও পড়ুন : কাপাসিয়ায় গৃহ নির্মাণে হরিলুট : দেখার কেউ নেই!

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, ওই দুর্নীতি কৌশলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত হলে বড় কর্তারাও ধরা পড়বেন।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মানবিক প্রকল্পের মত কাজে সংঘটিত দুর্নীতির শাস্তি না হলে অন্য প্রকল্পে সাহস আরও বাড়বে। অভিযুক্তদের নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকতে পারে।

অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যমতে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৩৭২টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প এ বরাদ্দ দিয়েছে। ঘরপ্রতি বাজেট ছিল এক লাখ টাকা।

বারান্দাসহ সাড়ে ১৬ ফুট দৈর্ঘ্যের ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থের টিনশেডে পাকা ভিটি। সাথে টয়লেট।

প্রকল্পটির আহ্বায়ক ইউএনও ও সদস্যসচিব পিআইও। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন কমিটিতে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানও সদস্য।

তবে পিআইও বাকি বিল্লাহ ও প্রকৌশলী উত্তম কুমার ইচ্ছামত কাজ করেছেন। চেয়ারম্যানরা ছিলেন উপেক্ষিত।

সবচেয়ে বেশি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে ঘাগটিয়া ইউনিয়নে। সেখানে ঘর ১৬৯টি।

আরও পড়ুন : কাপাসিয়ার ঘাগটিয়ায় গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির ছড়াছড়ি

ঘরগুলো নির্মাণে ইস্টিমেট মানা হয়নি। এক নম্বর ইটের বদলে দুই ও তিন নম্বর ইট দেওয়া হয়েছে ব্যাপক হারে।

অনেক ঘরে পিকেট খোয়ার বদলে ব্যবহার হয়েছে পরিমাণে কম ও নিম্নমানের খোয়া। ইটের গাঁথুনি মাটির নিচ থেকে না দিয়ে ওপর থেকে বসানো হয়েছে।

প্রতিটি ঘরে আরসিসি খুঁটি ১৭টি। মাটির এক ফুট নিচ থেকে গোড়ায় ছয় ইঞ্চি করে ঢালাই না দিয়েই খুঁটিগুলো স্থাপন করা হয়েছে।

ঘরের ১২টি খুঁটির দৈর্ঘ্য থাকার কথা ১২ ফুট এবং বারান্দা ও টয়লেটের নয়টিতে ১০ ফুট। কিন্তু এক ফুট করে কম দেওয়া হয়েছে।

প্রতি ফুটে দাম পড়ে ৫০ টাকা। সে হিসাবে ২১ ফুট কম দিয়ে ঘরপ্রতি আত্মসাৎ করা হয়েছে এক হাজার ৫০ টাকা।

এ ছাড়া খুঁটিগুলোতে ছয় মিলির চারটি রড দেওয়ার কথা থাকলেও কোথাও কোথাও দেখা গেছে দুটি। তা-ও আবার নিম্নমানের।

প্রতি ঘরে জানালা থাকার কথা চারটি। কিন্তু দুটি কম দিয়ে ঘরপ্রতি আত্মসাৎ করা হয়েছে ৭০০ টাকা।

ফ্লোরে তিন ইঞ্চির বদলে ঢালাই দেওয়া হয়েছে এক-দেড় ইঞ্চি। কিছু ঘরে দেখা গেছে নিম্নমানের কাঠ।

সিংহশ্রী ইউনিয়নে ৮৪টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তদন্তের পর সাত মাস অতিবাহিত হলেও টয়লেটগুলোর কাজ সম্পন্ন হয়নি।

আরও পড়ুন : কাপাসিয়ার সিংহশ্রীতে গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতি!

ঘরের চৌচালায় নয়টি টুয়ার দৈর্ঘ্য ৫৪ ফুট। দশমিক ৪৬ মিলির টুয়া ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও দশমিক ৩৬ ও মাঝে-মধ্যে দশমিক ৪২ মিলি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

অপরদিকে সিংহশ্রীতে উপকারভোগীদের দিয়ে বালু কেনানো হয়েছে। ঘাগটিয়ায় কেউ কেউ কিনে দিয়েছেন কিছু ইট ও সিমেন্ট।

এ ছাড়া দরজা ও জানালায় রং করা হয়নি। ইউএনও ইসমত আরা প্রথমে কিছু তৎপরতা দেখালেও পরে আর খবর পাওয়া যায়নি।

উপকারভোগীরা অভিযোগ করেন, দুর্নীতির কারণে ঘর টেকসই হয়নি। কাজ শেষ হতে না হতেই ফ্লোর ভেঙে ও দেবে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৬০-৭০ হাজার টাকা। সে হিসাবে ৩৭২ ঘর থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে এক কোটি টাকারও বেশি।

এ ব্যাপারে সাবেক পিআইও বাকি বিল্লাহ প্রথমে তথ্য দিতে রাজি না হলেও পরে একাধিকবার ফোন করে নিউজ না করার অনুরোধ করেছেন।

রাস্তা নির্মাণে দুর্নীতি : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃক রায়েদ ইউনিয়নের আওলাব বাজার থেকে সিংহশ্রী ইউনিয়নের কপালেশ্বর রোডের সংযোগ সড়কের কাজেও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

গত ১৮ মে ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪৬২ মিটার দৈর্ঘ্যের এ উন্নয়ন কাজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি।

ঝুঁকিতে আওলাব বাজার রোড

সরেজমিনে দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মা-মনি এন্টারপ্রাইজ দুই নম্বর ইট দিয়ে অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন করেছে। ধীরে ধীরে ইট সরে রাস্তা নষ্ট হচ্ছে।

বড়িবাড়ী বালিকা দাখিল মাদ্রাসা সংলগ্ন পূর্ব পাশের রাস্তাও দুই নম্বর ইট দিয়ে করা হয়েছে। খলিলের বাড়ির উত্তরে কিছু অংশ ভেঙে যাচ্ছে।

ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, পিআইও ও প্রকৌশলীকে কমিশন দিয়ে ঠিকাদাররা নিম্নমানের কাজ করেছেন। এ ধরনের চিত্র উপজেলায় আরও আছে।

জানতে চাইলে প্রকৌশলী উত্তম কুমার আলোকিত নিউজকে বলেন, প্রকল্পের কাজে দু-এক জায়গায় সামান্য সমস্যা মেরামত করে দেওয়া হয়েছে। দুই নম্বর ইটের কোন অস্তিত্ব পাইনি।

সংযোগ সড়কের এইচবিবিকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই কাজ তদারকির দায়িত্বে আমি ছিলাম না। সাবেক পিআইও নিজে করিয়েছেন।

আরও খবর