কাপাসিয়া এসিল্যান্ড অফিসে ঘুষ ছাড়া সেবা মেলে না, ভোগান্তি চরমে
আলোকিত প্রতিবেদক : ঘুষ দিলে কাজ দ্রুত হয়। ঘুষ না দিলে ফাইল আটকে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি করা হয়। এই চর্চা বিভিন্ন অফিসে নিয়মিত হয়।
কিন্তু ঘুষ না দিলে সুস্পষ্ট দলিল অস্পষ্ট হয়ে যায়। ঘুরতে হয় মাসের পর মাস। এই চর্চার প্রবণতা তুলনামূলক কম।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে সুস্পষ্টকে দলিলকে অস্পষ্ট দেখিয়ে সেবাপ্রার্থীকে হয়রানির এমনই একটি ঘটনার আদ্যোপান্ত পর্যবেক্ষণ করেছে আলোকিত নিউজ।
সিংহশ্রী ইউনিয়নের নামিলা গ্রামের আবদুল রহিম গত বছরের ৩০ মে দেড় একর জমির নামজারি ও জমাভাগের আবেদন করেন। নথি নম্বর ৩৮৮৪। তিনি ১৯৭৭ সালে বন্দোবস্তমূলে ওই জমির মালিক হন।
পরে রায়েদ ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা আলেয়া সরকার মোবাইলে আবেদনকারীকে ডেকে মূল দলিল দেখে টোক ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রতিবেদন দেন। সেখান থেকে সাবেক ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আবদুল লতিফ মিয়া নামজারি অনুমোদনের জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে প্রস্তাব পাঠান।
এরপর কানুনগো নুরুল ইসলাম কর্মচারী টুটুলের মাধ্যমে মোবাইলে আবেদনকারীকে ডেকে মূল দলিল দেখে প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন। এভাবে সব ধাপ পেরিয়ে নথি যায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজমুল হুসাইনের টেবিলে। তিনি গত ১৯ অক্টোবর প্রস্তাবটি নামঞ্জুর করেন।
নামঞ্জুরের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, আবেদনকারীর দাখিলকৃত দলিল অস্পষ্ট। তাই মালিকানা যাচাই করা যায়নি।
কানুনগো নুরুল ইসলাম বলেছেন, বন্দোবস্ত দলিলের ক্ষেত্রে যাচাই বলতে দলিলের ওপরে থাকা কেস নম্বর ভিপি রেজিস্টারে মিলিয়ে দেখা হয়। সব ঠিক পেয়েই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করা হয়েছে। খারিজ অনুমোদন না হওয়ার কোন কারণ নেই।
সার্ভেয়ার রফিকুল ইসলামও একই কথা বলেন। তার ভাষ্য, দলিল তো স্পষ্ট। কেন বাতিল করা হল, বুঝতে পারছি না।
এদিকে এসিল্যান্ড মূল দলিল দেখার বা শুনানির জন্য আবেদনকারীকে কখনো ডাকেননি। খারিজ নামঞ্জুর সংক্রান্ত কোন মেসেজও মোবাইলে যায়নি।
আবেদন করার সময় টোক ভূমি অফিসের একজন কর্মচারী বলেছিলেন, এটা বড় ফাইল। এসব ফাইলে এসিল্যান্ড অফিসে প্রতি পাঁচ শতাংশে এক হাজার টাকা করে ‘এলআর’ দিতে হয়। টাকা না দিলে খারিজ দিতে চায় না।
আবেদনকারী গত ডিসেম্বরে খারিজ বাতিলের খবর পেয়ে এসিল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করে মূল দলিল দেখান। এসিল্যান্ড দলিলে কোন অস্পষ্টতা পাননি। আবেদনকারী রিভিউ করার কথা বললে তিনি নামজারি সহকারী মাহবুবুর রহমানকে ডেকে তা দেখতে বলেন।
এবার মাহবুবুর রহমান সার্ভারে সমস্যার কথা বলে রিভিউ বাইরে থেকে করার পরামর্শ দেন। পরে বাইরে থেকে বারবার চেষ্টা করেও রিভিউ করতে না পেরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করা হয়।
সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিস্তারিত শুনে ও অনলাইন আইডি নম্বর নিয়ে আবেদনের অবস্থা দেখে বলেন, নাগরিক কর্নার বা বাইরে থেকে রিভিউ করার কোন সুযোগ নেই। এটা এসিল্যান্ড করে দেন। এসিল্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
তবে মন্ত্রণালয়ের কথা মানতে নারাজ এসিল্যান্ড নাজমুল হুসাইন। তিনি সর্বশেষ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বলেন, রিভিউ কেন অফিস থেকে করতে হবে? এটা নাগরিক কর্নার থেকে করবেন। অফিস থেকে তো রিভিউ করার প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের আবেদন অহরহ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, টোক ভূমি অফিসের নথি উপস্থাপন করেন নামজারি সহকারী মাহবুবুর রহমান। তিনি লেনদেনের হিসাব রাখেন। এসিল্যান্ডও তার ওপর নির্ভর করেন। দেড় একরে ‘এলআর’ নামের ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিলেই খারিজ অনুমোদন হয়ে যেত। টাকা না দিলে হয়রানির শেষ নেই। নতুন করে আবেদন করে চুক্তিতে আসলে কাজ হাসিমুখে হয়ে যাবে।
সূত্র আরও জানায়, মাহবুবুর রহমান অত্যন্ত কৌশলী। তিনি নিজে আবেদনকারীদের সঙ্গে চুক্তি করেন কম। সাধারণত ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের কাছ থেকে হিসাব বুঝে নেন। কিছু বাদে সব খারিজেই বাণিজ্য হচ্ছে। এসিল্যান্ড অফিসে বর্তমানে ঘুষের রেটও বেশি।
রিভিউ প্রসঙ্গে গাজীপুরের একজন এসিল্যান্ডের সঙ্গে কথা হয় আলোকিত নিউজের। তিনি বলেন, রিভিউ বাইরে থেকে করতে হয় না। অস্পষ্ট দলিলের কারণে আবেদন নামঞ্জুর হলে স্পষ্ট দলিল দেখালে নিজেরা রিভিউ করে দিই। আমরা মন্ত্রণালয়ে কল করে বললেই নথি অ্যাকটিভ করে দেয়।
গত বছরের ১৭ জুলাই ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্রে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, কোন তথ্যের ঘাটতি থাকলেই নামজারি আবেদন নামঞ্জুর করা যাবে না। প্রথম আদেশে দলিলপত্রের ঘাটতি থাকলে যুক্তিসংগত সময় দিতে হবে। আবেদনকারী কাগজপত্র দাখিলে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় আদেশে নামঞ্জুর করা যাবে। পরবর্তীকালে চাহিত তথ্য বা দলিলপত্রের প্রাপ্তি সাপেক্ষে পুনরায় কার্যক্রম চালু অর্থাৎ রিভিউ করতে হবে।
একজন ভূমি কর্মকর্তা বলেন, সরকার ভূমিসেবা সহজ করলেও একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। এগুলো দমনে জেলা প্রশাসনসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ জরুরি।