গাজীপুরের ভবানীপুর বিটে বনভূমি দখলের হিড়িক, বাণিজ্য রমরমা
আলোকিত প্রতিবেদক : গাজীপুর সদরের মেম্বারবাড়ী বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশে স্বপ্ন সুপারশপের পেছনে সিএস ৬৫০ নং দাগের মূল্যবান বনভূমিতে বারান্দাসহ চার রুমের পাকা বাড়ি করছেন আতিকুল ইসলাম।
বাড়িটির নির্মাণ কাজ গত মাসে শুরু হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটনাটি ঘটলেও রক্ষকরা কোন ব্যবস্থা নেননি।
বনভূমিতে আতিকুলের নির্মাণাধীন বাড়ি
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের অধীন ভাওয়াল রেঞ্জের ভবানীপুর বিটে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে বিঘার বিঘা বনভূমি দখল হচ্ছে। অবাধে চলছে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য।
বিটের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, মেম্বারবাড়ী থেকে পাঁচ পীরের মাজার রোডে বারিধারা প্যাকেজিং কারখানার দক্ষিণ পাশে সিএস ৭৬৮ নং দাগের বনভূমিতে আগেই ১৭ রুমের পাকা বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছেন হারুন অর রশিদ। গত নভেম্বরে দখল সম্প্রসারণ করে নির্মাণ করেছেন আরও ১২টি রুম।
বনভূমিতে হারুন বিএসসির নবনির্মিত বাড়ি
একই সঙ্গে তিনি ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বাউন্ডারি ওয়ালও নির্মাণ করেছেন। বিট অফিস কখনো বাধা দেয়নি। নেয়নি আইনগত ব্যবস্থা।
হারুন বিএসসির এক স্বজন বলেন, ওই জমি বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত হলেও রেকর্ড তাদের নামে। বিট অফিসের আর কী করার আছে?
বারিধারা প্যাকেজিংয়ের উত্তর পাশে সিএস ৭৬৭ নং দাগে গত ডিসেম্বরে লিটন হাজি বনভূমি দখল করে গোডাউন নির্মাণ করেছেন। এখন তার বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে খালি থাকা বনভূমিতে পাকা আট রুমের কাজ চলছে।
বনভূমিতে লিটন হাজির নবনির্মিত গোডাউন
লিটন হাজির গোডাউনের উত্তর পাশে বনভূমি দখল করে সম্প্রতি বারান্দাসহ ছয় রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন ছফুর উদ্দিন মুন্সির মেয়ে কারিমা। তার বাড়ির পশ্চিম পাশে বনভূমিতে বারান্দাসহ নতুন আট রুমের বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছেন আল-আমিন।
বনভূমিতে আল-আমিনের নবনির্মিত বাড়ি
বিট অফিস রোডে নেওয়াজ স্টিল মিলসের দক্ষিণ পাশে আজাইন্নার টেক। সেখানকার সিএস ২৫১ নং দাগের বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ ছয় রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন তবারক হোসেন। গত নভেম্বরের দিকে কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেষ হয়।
বনভূমিতে তবারকের নবনির্মিত বাড়ি
ভবানীপুর বাজারের স্কুল রোডে সিএস ১৪২২ নং দাগের বনভূমিতে তিনটি পাকা দোকান নির্মাণ করেছেন হযরত আলী ও মোহাম্মদ আলী। এখন দোকানের পেছনের অংশ বড় করার কাজ চলছে।
বনভূমিতে নির্মিত আরিফ ও সিদ্দিকের দোকান
বাজার মসজিদের দক্ষিণ পাশের গলি দিয়ে ভেতরে বনভূমি দখল করে নির্মিত দুটি দোকান সম্প্রতি পাকা করেছেন আরিফ ও সিদ্দিক। সাহিদা মেম্বারের বাড়ির পেছনে বনভূমিতে গত বছরের শেষ দিকে দুটি টিনশেড রুম করেছেন জালাল। রুম পুরনো দেখাতে টিনে আলকাতরা দেওয়া হয়েছে।
বনভূমিতে জালালের নবনির্মিত বাড়ি
সার্ভেয়ার হাসানের বাড়ির পেছনে গত মাসে বনভূমি দখল করে তিন রুমের টিনশেড বাড়ি নির্মাণ করেছেন হানিফ। রুম পুরনো দেখাতে টিনে আলকাতরা দেওয়া হয়েছে। নতুন মসজিদের পাশে কলার আড়তের পেছনে বনভূমিতে গত মাসে দুটি টিনশেড রুম করেছেন বিল্লাল।
বনভূমিতে হানিফের নবনির্মিত বাড়ি
মুক্তিযোদ্ধা কলেজ রোডে গত মাসে স্থানীয় একজন বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ টিনশেড রুম করেছেন। কিছু স্থাপনায় দালাল আবদুল খালেকের মাধ্যমে বিট অফিসে লেনদেন হচ্ছে বলে অভিযোগ।
মোহাম্মদীয়া কারখানার উত্তর দিকে গত বছর বনভূমির ওপর দিয়ে ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ইটের সলিং রাস্তা নির্মাণ করেছেন কৃষি ব্যাংকের দালাল ফাইজ উদ্দিন। বিট অফিস প্রথমে ইট তুলে ফেললেও কয়েক দিনের মধ্যে আবার সলিং বহাল হয়।
বনভূমি দিয়ে ফাইজ উদ্দিনের রাস্তা
এদিকে মেম্বারবাড়ী থেকে পাঁচ পীরের মাজার রোডে বারিধারা প্যাকেজিংয়ের পাশে সিএস ৭৪৫ নং দাগের বনভূমি দখল করে ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করছেন বিল্লাল হোসেন। বাড়িটির নিচ তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বিল্লাল বিট কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিনের আমলে বাড়ির কাজ শুরু করেন। রেঞ্জ অফিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা এক দালাল এতে মধ্যস্থতা করেছেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, নাজিম উদ্দিনের পর বিট কর্মকর্তা শাহান শাহ আকন্দের সময়ে বেশ দখল বাণিজ্য হয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে ভবানীপুর বিটের চলতি দায়িত্বে আছেন বারুইপাড়া বিট কর্মকর্তা আবুল কালাম শামসুদ্দিন। কারও আমলেই দখল থামছে না।
স্থাপনা ভেদে ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই-তিন লাখ টাকা অহরহ লেনদেন হচ্ছে। শুধু অনুমতি ছাড়া কেউ কিছু করলে বা ওপরের নির্দেশে ভাঙচুর ও মামলা দেওয়া হয়। এ ছাড়া উচ্ছেদ কার্যক্রমের তেমন নজির নেই।
এ ব্যাপারে বিট কর্মকর্তা আবুল কালাম শামসুদ্দিন আলোকিত নিউজকে বলেন, আগে বাড়িঘরের কিছু কাজ হয়েছে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সব নিয়ন্ত্রণে আছে।
রেঞ্জ কর্মকর্তা মাসুদ রানা আলোকিত নিউজকে বলেন, তিনি যখনই দখলের খবর পান, সঙ্গে সঙ্গে বিট কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। যেটা ভাঙা যায় না, সেটার ক্ষেত্রে মামলা দেওয়া হয়।
একজন বন কর্মকর্তা বলেন, বনভূমি দখল হলে সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিরোধ করা। প্রতিরোধ করতে না পারলে ফোর্স নিয়ে উচ্ছেদ করতে হবে। অভিযোগ উঠলে কেবল মামলা করে দায় সারলে বনভূমি রক্ষা হয় না।
তিনি আরও বলেন, দখল নতুন হলেও কর্মকর্তারা বলেন যে এটা তার সময়ে হয়নি। আবার বলেন কাজ আগে হয়েছে, এখন টিন পাল্টিয়েছে বা রং করেছে। এসব হচ্ছে ঘটনা ধামাচাপার কৌশল। তাই বনভূমি রক্ষায় প্রয়োজনে উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের মাধ্যমে আগের-পরের লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।