গাজীপুরের ভবানীপুর বিটে বন দখল, টিনশেড ভেঙে পাকা স্থাপনা বহাল!

আলোকিত প্রতিবেদক : গাজীপুরের ভবানীপুর বিটে নতুন দখলকৃত পৌনে দুই বিঘা মূল্যবান বনভূমি উদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

একই সঙ্গে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বন বিভাগ।

বড় ঘটনা ধামাচাপা দিতে কয়েকটি টিনশেড স্থাপনায় ভাঙচুর চালিয়ে কৃতিত্বের ঢেঁকুর তুলছে ভাওয়াল রেঞ্জ অফিস।

এর আগে গত ১১ এপ্রিল আলোকিত নিউজ ডটকমে ‘গাজীপুরের ভবানীপুর বিটে বনভূমি দখলের হিড়িক, বাণিজ্য রমরমা’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে চলে তোলপাড়।

পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এনামুল হককে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

আরও পড়ুন : গাজীপুরের ভবানীপুর বিটে বনভূমি দখলের হিড়িক, বাণিজ্য রমরমা

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলোকিত নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশের পর রেঞ্জ কর্মকর্তা মাসুদ রানা বিট অফিসকে কিছু নির্দেশনা দেন। নির্দেশনা অনুযায়ী বিটের চলতি দায়িত্বে থাকা বারুইপাড়া বিট কর্মকর্তা আবুল কালাম সামসুদ্দিন স্টাফ নিয়ে অভিযানে যান।

এ সময় ভবানীপুর বাজার এলাকার কয়েকটি টিনশেড স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। এরপর বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে ওপরে জানানো হয়।

অথচ বড় বড় স্থাপনায় হাতই দেওয়া হয়নি। সেসব বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়ে দখলদাররা অর্থ উর্পাজন অব্যাহত রেখেছেন।

তাদের মধ্যে শিরিরচালা এলাকার বারিধারা প্যাকেজিং কারখানার দক্ষিণ পাশে সিএস ৭৬৮ নং দাগের গেজেটভুক্ত বনভূমিতে নতুন ১২টি পাকা রুম নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন হারুন অর রশিদ। সেখানকার বনভূমিতে তিনি আগেও ১৭ রুমের বাড়ি করেছেন।

হারুন বিএসসি গত নভেম্বরে দখল সম্প্রসারণ শুরু করায় নতুন করে আধা বিঘা বনভূমি বেহাত হয়েছে। একই সঙ্গে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বাউন্ডারি ওয়ালও নির্মাণ করেছেন এই প্রভাবশালী।

বারিধারা প্যাকেজিংয়ের পাশে সিএস ৭৪৫ নং দাগের তিন শতাংশ বনভূমি দখল করে ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করছেন বিল্লাল হোসেন। বাড়িটির নিচ তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

গত ডিসেম্বরে বারিধারা প্যাকেজিংয়ের উত্তর পাশে সিএস ৭৬৭ নং দাগের ১০ শতাংশ বনভূমি দখল করে গোডাউন নির্মাণ করেছেন লিটন হাজি। গোডাউনের সামনের অংশের বনভূমিতে মালবাহী গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

লিটন হাজির বাড়িও বনভূমিতে পড়েছে। দুই মাস আগে তার বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে খালি থাকা তিন শতাংশ বনভূমিতে পাকা আট রুমের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

লিটন হাজির গোডাউনের উত্তর পাশে পাঁচ শতাংশ বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ নতুন ছয় রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন ছফুর উদ্দিন মুন্সির মেয়ে কারিমা।

কারিমার বাড়ির পশ্চিম পাশে আল-আমিন ছয় শতাংশ বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ নতুন আট রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন।

বিট অফিস রোডে আজাইন্নার টেকে সিএস ২৫১ নং দাগের আট শতাংশ বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ ছয় রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন তবারক হোসেন। বাড়ির সামনের অংশে রোপণ করা হচ্ছে বিভিন্ন গাছ। বাড়িটির কাজ গত নভেম্বরের দিকে শুরু হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেষ হয়।

বানিয়ারচালা এলাকায় সিএস ৬৪৯ নং দাগের সাত শতাংশ বনভূমি দখল করে বারান্দাসহ চার রুমের পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন আতিকুল ইসলাম। বাড়িটির কাজ শুরু হয় গত মার্চে।

রেঞ্জ অফিস জানায়, আলোকিত নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন বিট কর্মকর্তা আবুল কালাম সামসুদ্দিন স্টাফ নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলে আতিকুল গং হামলা চালানোর চেষ্টা করে। পরে এ ঘটনায় জয়দেবপুর থানায় একটি সাধারণ ডাইরি করা হয়। জিডি নম্বর ৬১৪।

ভবানীপুরের মোহাম্মদীয়া কারখানার উত্তর দিকে গত বছর বনভূমির ওপর দিয়ে ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ইটের সলিং রাস্তা নির্মাণ করেছেন কৃষি ব্যাংকের দালাল ফাইজ উদ্দিন। বিট অফিস প্রথমে ইট তুলে ফেললেও কয়েক দিনের মধ্যে আবার তা বহাল হয়।

এ ছাড়া ভবানীপুর বাজারের স্কুল রোডে সিএস ১৪২২ নং দাগের বনভূমিতে তিনটি পাকা দোকান নির্মাণ করেছেন হযরত আলী ও মোহাম্মদ আলী। আলোকিত নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিট অফিস দোকানের পেছনের সম্প্রসারিত কিছু অংশ ভাঙলেও আবার তা সম্পন্ন হয়েছে।

পৃথক পৃথক স্থানে এভাবে অন্তত পৌনে দুই বিঘা বনভূমি দখলদারদের কবজায় চলে গেছে। যার স্থানীয় বাজারমূল্য প্রায় সাত কোটি টাকা।

আরও পড়ুন : গাজীপুর বন্যপ্রাণী অঞ্চলে রেঞ্জার ও ফরেস্টার সংকট, বেড়েছে বন দখল

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বনভূমিতে কেউ ছোট বা টিনশেড স্থাপনা করতে চাইলে স্টাফরা কথা বলে কাজ দেন। বড় স্থাপনার ক্ষেত্রে বিট কর্মকর্তা বা রেঞ্জ অফিসের সঙ্গে চুক্তি হয়। আর এসবে লাখ লাখ টাকা লেনদেন এখন ওপেন সিক্রেট।

সূত্র আরও জানায়, রেঞ্জ অফিসে রফিক নামের এক দালালের দহরম-মহরম সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও ব্যক্তির পক্ষে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেনদেন থাকায় স্থাপনা ভাঙতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়।

একজন বন কর্মকর্তা বলেন, বড় স্থাপনাগুলোর কাজ সম্পন্ন হতে মাস-দুয়েক বা বেশ কিছুদিন সময় লাগে। কর্মকর্তারা জড়িত না থাকলে এভাবে কাজ চলা সম্ভব নয়। তদন্ত কমিটি ও কর্তৃপক্ষ বন রক্ষায় আন্তরিক না হলে লুটপাট চলতেই থাকবে।

এদিকে লুটেরা চক্র আলোকিত নিউজের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেছে। তারা বলছে, আলোকিত নিউজ সব সময় বন বিভাগের বিপক্ষে লিখে। আলোকিত নিউজের নিবন্ধনও নেই।

অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আলোকিত নিউজ সরকারি নীতিমালায় আবেদিত ও পরিচালিত। আলোকিত নিউজ বন বিভাগ তথা রাষ্ট্রের স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিষয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।

এর ফলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মাঠ পর্যায়ের দুর্নীতির তথ্য জানতে পেরে ব্যবস্থা নিতে পারছে। উদ্ধার ও বনায়নের মাধ্যমে রক্ষা পাচ্ছে বিঘার বিঘা বনভূমি। সেসব ফলোআপও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন : গাজীপুরে ডিমারকেশন ছাড়াই নিচু জমি ভরাট করছে ‘বনখেকো’ প্যারাগন!

আরও খবর